এএসআই কামরুলের হাতে আলাদীনের চেরাগ!

বাংলা নিউজ ◑

পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে শুরু করেছিলেন চাকরি জীবন। তারপর পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান এএসআই। সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, দায়িত্ব পালনের সময় ও এর বাইরে সাধারণ পোষাকে মানুষকে হয়রানি, চাঁদাবাজি, মারধর করে তিনি বেশ আলোচিত হন। গড়েছেন বিত্ত-বৈভব। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির বলে বারবার পার পেয়ে গেছেন।

জানা গেছে, রাঙামাটির বাঙালহালিয়ার বাসিন্দা এএসআই কামরুল হাসান নগরের কোতোয়ালী থানার বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত থাকা অবস্থায় হয়ে উঠেন আরও বেশি বেপরোয়া। সর্বশেষ বুধবার (২৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় টেরিবাজারে লকডাউনের মধ্যে দোকান খোলা পাওয়ায় ৬০ বছর বয়সী গিরিধারী চৌধুরী নামের এক ব্যক্তিকে বেধড়ক পেটানোর পর তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনাকেও ‘হৃদরোগ’ বলে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এএসআই কামরুল। তবে স্থানীয় দোকান কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে এএসআই কামরুল হাসান ও দুই কনস্টেবলকে সাময়িক প্রত্যাহার করা হয়েছে।

টেরিবাজারের প্রার্থনা বস্ত্রালয়ের কর্মচারী নিখিল দাশ জানান, প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার গিরিধারী চৌধুরী ও তাকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের এই কর্মকর্তা অনেক্ষণ ধরে থাপ্পড় মারার পর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান গিরিধারী। পরে তার মৃত্যু হয়।

বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত এএসআই কামরুল হাসান।গিরিধারী চৌধুরী পটিয়ার হাইদগাঁওয়ের বাসিন্দা। থাকতেন টেরিবাজার এলাকায়। তার এক মেয়ে কক্সবাজারে পুলিশ কনস্টেবল ও মেয়ের জামাই পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক, যিনি বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‌র‌্যাবে দায়িত্বরত আছেন বলে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার (৩০ এপ্রিল) বিকালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিরিধারীর ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়িতে মরদেহ দাহ করা হয়।

টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির একজন নেতার দাবি, পুলিশ ও সমিতির নিয়োগ করা দারোয়ান কফিল উদ্দিনসহ অন্যরা মিলে এই বয়স্ক মানুষটিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। শ্রমিকদল নেতা কফিল উদ্দিন ব্যবসায়ীদের নানা অজুহাতে জিম্মি করে টাকা আদায় করাসহ পুলিশ বিটের পুলিশ সদস্যদের সোর্স হিসেবে কাজ করে।

এএসআই কামরুলের বিরুদ্ধে এর আগে গত ১৭ এপ্রিল টেরিবাজারের ৬ নম্বর গলিতে একটি মুড়ির গুদামে ঢুকে কর্মচারী অপু পালকে পেটানোর অভিযোগ উঠে। ওই মুড়ির গুদামের মালিক জানিয়েছিলেন, ‘এএসআই কামরুল তার কাছে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। চাঁদা না দেওয়ায় তার গুদামে ঢুকে কর্মচারীকে বেধড়ক পেটায় কামরুল।’

পুলিশের এই সদস্যের বিরুদ্ধে এলাকার দোকানদার, ভ্যানে পণ্য বিক্রেতাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, বিভিন্ন অজুহাতে টাকা দাবি এবং আদালত থেকে কারো নামে থানার মাধ্যমে চিঠি এলে ওই ব্যক্তিকে ফাঁড়িতে নিয়ে জিম্মি করে পরিবার থেকে টাকা আদায় করার অভিযোগও রয়েছে স্থানীয়দের। ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হয়রানি করতেন এএসআই কামরুল হাসান।

টেরিবাজারের একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, করোনার কারণে বন্ধ থাকা দোকান খোলা পেলেই ব্যবসায়ীদের পেটাতেন তিনি। কয়েকদিন আগেও বক্সিরহাটের বদর হোটেলের এক কর্মচারীকে পিটিয়েছেন তিনি।

গিরিধারী চৌধুরীর ছেলে পরশ চৌধুরী বলেন, আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। পারিবারিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মামলা করবো।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় এমবিএ পরীক্ষা দেওয়ার সময় থেকেই তার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ সবার নজরে আসে। এর আগে ২০০৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ২০০৮-০৯ সালে কনস্টেবল এবং ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি তৎকালীন ওসির সুনজরে থাকায় এএসআই পদে পদোন্নতি পান। প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে কোতোয়ালী থানা ও বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত আছেন তিনি।

এএসআই কামরুলের বাড়ি।পুলিশে চাকরি নেওয়ার পর চাঁদাবাজির টাকায় রাঙামাটির বাঙালহালিয়ায় ৪০-৫০ লাখ টাকা খরচ করে মায়ের নামে ‘আমেনা মঞ্জিল’ বাড়ি করেছেন। নজরদারির জন্য লাগিয়েছেন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। ঘর সাজিয়েছেন দামি আসবাবাপত্রে। প্রায় ৯ লাখ টাকায় গাড়িও কিনেছেন বছর দুয়েক আগে। আয়েশি জীবনযাপন এবং এলাকায় তার বেশ প্রভাব থাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। পুলিশের বেতন-ভাতা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এএসআই কামরুলের ভাইপো বখাটে রানার হাত থেকে বাঁচতে গত বছরের ৩ নভেম্বর রাতে বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের শফিপুর গ্রামের সাহেব আলীর মেয়ে ও বাঙ্গালহালিয়া সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শামীমা আক্তার (১৮) বিষপানে আত্মহত্যা করে বলে অভিযোগ উঠে।

নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করেছিলেন, বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের ডাকবাংলা পাড়ার বাসিন্দা রানা শামীমাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। এরই মধ্যে এক প্রবাসী যুবকের সঙ্গে শামীমার বিয়ে ঠিক হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রানা কিছু অশ্লীল ছবি এডিট করে শামীমার প্রবাসী হবু স্বামীর ইমো নম্বরে পাঠায়। এ নিয়ে হবু স্বামীর সঙ্গে শামীমার সম্পর্কের অবনতি হয়। এ ঘটনার পর অপমান সইতে না পেরে শামীমা বিষপান করে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক রানাকে আটক করতে এলাকাবাসী বাঙ্গালহালিয়া বাজারে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করে। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে বখাটে রানাকে আসামি করে চন্দ্রঘোনা থানায় ৫ নভেম্বর মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু এএসআই কামরুলের প্রভাবে সে পার পেয়ে যায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে ডেকে এনে দাওয়াত খাইয়ে এসময় আলোচনায় আসেন কামরুল।

টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘টেরিবাজারের সব দোকান এখন বন্ধ আছে। বুধবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে মোহাদ্দিস মার্কেটের প্রার্থনা বস্ত্রালয় খুলে সেখান থেকে কয়েকজন কর্মচারী বস্তায় করে কাপড় বের করছিলেন। বস্তাগুলো রিকশায় তোলার সময় মার্কেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন তাদের জেরা করে। পরে সেখানে টহল পুলিশ আসে। পুলিশ চার বস্তা কাপড়সহ দুই কর্মচারীকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি, সেখানে একজন কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেছেন’।

গিরিধারী চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় এখন দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে ফুঁসছেন টেরিবাজারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। তারা এএসআই কামরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং তাকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছেন।

এদিকে এ ঘটনার পরপরই সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তা দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। এমনকি গত দুদিনেও থানায় কোনো মামলা নথিভুক্ত হয়নি।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার নোবেল চাকমা ও কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন।

সিএমপির উপ-কমিশনার এসএম মেহেদী হাসান বলেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছি। নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে আটক হওয়ার পর পুলিশের টহল টিম গিরিধারী চৌধুরীকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। দায়িত্বে অবহেলার দায়ে এক ওই এএসআই ও দুই কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।